Dhaka ১২:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খুলনার দাকোপে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাজুয়াবাসীর ভরসার একটি নাম  ডা. মুরারি মোহন মণ্ডল  

  • Reporter Name
  • Update Time : ১২:৫৫:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ অগাস্ট ২০২৩
  • ৩৩৭ Time View
মোঃ শামীম হোসেন- খুলনা প্রতিনিধিঃ-
খুলনার দাকোপে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাজুয়াবাসীর ভরসার একটি নাম  ডা. মুরারি মোহন মণ্ডল। কেননা দাকোপ উপজেলা ৯ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। যার ৫ টি ইউনিয়ন নিয়ে বাজুয়া বাজার। আর এখানে নেই কোন হাসপাতাল বা ডাঃ মুরারি মোহন মন্ডল ছাড়া অন্য কোন এমবিবিএস ডাক্তার। এলাকা বাসীর কাছ থেকে জানা যায় এই ৫ টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষের কেউ অসুস্থ হলে ডাঃ মুরারি মোহন মন্ডল হচ্ছে একমাত্র ভরসা যদি ডাক্তার রোগী দেখেন তাহলে সে বাজুয়াতে চিকিৎসা পাবে আর যদি না দেখে তবে তাকে হয় উপজেলা সদর বা খুলনার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নাই ভুক্তভোগী রোগীদের মধ্য থেকে জানায় ভাগ্য ভালো থাকলে সে রোগী বাঁচবে না হয় পথে মারা যাবে কারণ বাজুয়া থেকে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনেক সময় লাগে তাই ইমার্জেন্সি রোগী পথেই মারা যায়। বাজুয়ায় ডাঃ মুরারি মোহন মন্ডল ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। তাই তো কবির ভাষায় মন বলে, সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান, সেই তো তোমার দান। মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ সেই তো তোমার প্রাণ।” কিছু মানুষের অদৃশ্য অবদান আমাদের সমাজকে প্রতিনিয়ত ঋণী করে চলেছে। কিছু মানুষের কথা মনের ক্যানভাসে অজান্তে ফুটে ওঠে গভীর ভালবাসায়। মানবসেবার নামে যখন স্বার্থনেশীদের আত্মপ্রচারে দাকোপের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, ঠিক তখন নিভৃত পল্লীতে প্রচারবিমুখ একজন মানুষ মানবসেবার ব্রত নিয়ে, আত্মউৎসর্গ করে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। হ্যাঁ, আজকের গল্প এমনি একজন মহৎ মানুষকে নিয়ে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাজুয়াবাসীর ভরসার একটি নাম “মুরারি বাবু (ডা. এম. এম. মণ্ডল)”। এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায় অবিভক্ত বাংলায় সুন্দরবনের কোলঘেসে সদ্য জঙ্গল কেটে আবাদি জমিতে বসতি স্থাপন করেছে কৃষিনির্ভর এক জনপদ। জনশ্রুতিতে জানা যায় যে, এখানকার ঝোপ-জঙ্গল দা দিয়ে কুপিয়ে নির্মূল করা হয়। তাই এখানকার নামকরণ করা হয় দাকুপী। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে দাকুপী নামের কিঞ্ঝিৎ সংশোধন হয়ে দাকোপ নামে থানার প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৫ সালের প্রথম দিকের কথা, দাকোপের ছোট একটি গ্রাম খুটাখালী(বর্তমানে লাউডোব ইউনিয়নের অধীন)। খুটাখালী গ্রামে পিতা সতীশ চন্দ্র মণ্ডল ও মাতা কালীদাসী মণ্ডলের কৃষিনির্ভর অভাব-অনাটনের সংসার। সংসারে চার ভাই ও পাঁচ বোনের মাঝে ষষ্ট মুরারি মোহন মণ্ডল। দু’বিঘা জমি আর একটা ভিটা বাড়ীতে ঘরের চারপাশে কিছু ফলবান গাছ আছে। কষ্টে সৃষ্টে সংসার চালিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ার খরচটা জোগাড় করতেই পিতা সতীশ বাবুকে হিমশিম খেতে হয়। পাঠশালার পড়া শেষ  করে মুরারি মোহন ভর্তি হলেন বাজুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (স্থাপিত-১৯২০ সাল)।  অভাবের সংসারের টানাপোড়েনের মাঝ থেকে সফলতার সাথে ১৯৭৫ সালে প্রাথমিক শেষ করেন তিনি। অনেক অনিশ্চয়তার মাঝে মাধ্যমিক শুরু করেন উত্তর বানীশান্তা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টি তখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু ছিল(জুনিয়র স্কুল)। ১৯৭৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি প্রাপ্তিসহ উল্লেখযোগ্য নম্বর নিয়ে তিনি উত্তীর্ণ হন। পরে চলে আসেন এলাকার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম স্বনামধণ্য বিদ্যাপীঠ বাজুয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে(স্থাপিত-১৯২০ সাল)। ১৯৮০ সালে মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন দক্ষিণ বাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ বাজুয়া সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ে(স্থাপিত-১৯৭২ সাল)। ১৯৮২ সালে প্রথম শ্রেণী নিয়ে সফলতার সাথে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। অভাব অনটনে দিশেহারা বাবার কাছে উচ্চশিক্ষার খরচের আশা না করেই নেমে পড়েন উচ্চ শিক্ষার ভর্তি যুদ্ধে। সফলতা এলো! সফলতা এলো বাবা মায়ের, সফলতা এলো মুরারি মোহন মণ্ডলের, সফলতা এলো দাকোপের। দাকোপের চিকিৎসা অঙ্গনের জন্য এই সফলতা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। একান্ত আলাপচারিতায় তাঁর ভাষ্য-“আমি মেধাবী না, তবে পরিশ্রম করেছি, সফলতা পেয়েছি”। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে তিনি এমবিবিএস শেষ করে ১৯৮৯ সালে ফিরে আসেন এলাকার মানুষের সেবায়। শুরু হয় তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের। গল্পকথা বা ছোট বেলায় লেখা “Aim in Life” রচনা নয়। এটা বাস্তবতা, নিজের এলাকা বাজুয়া বাজারে ছোট্ট একটা রুমে তিনি শুরু করলেন চিকিৎসা সেবা। মাত্র ২০ টাকা, পরবর্তীতে এলে মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে তিনি সেবা দিলেন ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ সাল -৩০/২০ টাকা; ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল- ৪০/৩০ টাকা; ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল- ১০০/৫০ টাকা এবং ২০১৫ সাল থেকে ১৫০/১০০ টাকার বিনিময়ে তিনি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এরই মাঝে তিনি হয়ে উঠেছেন দারিদ্র জর্জরিত দাকোপবাসীর ভরসার একটি নাম, “মুরারি বাবু”; কুড়িয়েছেন অনেকের আশীর্বাদ ও ভালবাসা। একমাত্র মেয়ে মৈত্রী মণ্ডল(১৭), ছেলে স্বপ্নিল মণ্ডল (১৫) এবং সহধর্মিণী সঞ্চিতা রায়কে ঘিরে পারিবারিক জীবন। অনেকের কাছে রসকষহীন, এই মানুষটাকে খুব কাছে থেকে যারা না দেখেছে তারা বিশ্বাসই করতে পারবেন না যে তিনি কতটা রসিক। কথায় কথায় উঠে এলো তাঁর জীবনের নানান মজার ঘটনা, নানান আক্ষেপ এবং অনেক মূল্যবান কিছু মতামত। বড় আক্ষেপের জায়গা এলাকার সচেতন শিক্ষিত সমাজের উপর। অনেক উদাহরণ টেনে বললেন, যাদের কাছে সচেতনতা আশাকরি তারাই বেশি ভুল করে, অনিয়ম করে চিকিৎসায়। অথচ গরীব, অশিক্ষিত মানুষকে কিছু বললে তারা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তাঁর মতে, মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। সমাজে এসেছে অনেক পরিবর্তন। কিন্তু দাকোপ নামের এই বদ্বীপে এখনো তৈরি হয়নি কোন ভাল মানের চিকিৎসাকেন্দ্র, নেই উপজেলা সদরের সাথে সরাসরি কোন যোগাযোগ। নদীবেষ্টিত এপারের মানুষের জরুরী সেবার নেই কোন সুব্যবস্থা। এ বিষয়ে সরকারি পর্যায়ের সহযোগিতা কামনা করলেন তিনি।
২০১৬ সালের মে মাসে তিনি হৃদযন্ত্রের  বড় অপারেশন করতে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতে। অপারেশন শেষে এখন অনেকটা নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করছেন, আর দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা পরামর্শ, পুরানো সেই চেম্বরে। নিয়ম করে হাঁটছেন সকাল বিকাল। জানতে চেয়েছিলাম এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর মন্তব্য। তিনি বললেন, “আমাদের দেশে প্র্যাকটিক্যাল, লজিক্যাল , টেকনিক্যাল ও সাইনটিফিক বিকাশের উল্লেখযোগ্য কোন সুযোগ নাই। শুধু আছে মুখস্ত বিদ্যা বিকাশের সুযোগ । আর দাকোপের কথা আরো ভিন্ন! এখানে সব শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরাই পড়ে হয় শহরে, না হয় মংলা পারের নেভি স্কুলে। তার মানে শিক্ষকদের নিজেদের  আত্মবিশ্বাস কম। যদি এই বিশ্বাস থাকত যে নিজের স্কুলে ভাল পড়ালেখা হয় তাহলে সে নিজের সন্তানকে নিজের স্কুলেই দিত। ব্যাপারটা সামগ্রিক, আংশিক নয়। দুইএক জন যে ভাল নেই তা নয়, সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে দাকোপ পারের অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার এবং পাঠদানের মান উন্নয়ন তেমন হয়নি। তাই হয়তোবা অনেকে নদী পার হলে আর ফিরতে চান না এপারে। শত প্রতিকূলতার মাঝে কিভাবে সময় কাটে নিজের আপনজনের তা ভেবে দেখার সময়ই হয় না হয়তো অনেকের। নিজের চেম্বরে বসে দেখা যায় পারাপারের মানুষ; দেখেছেন অনেককেই পার হয়ে যেতে নদী, পাড়ি জমাতে শহরে ভাগ্যের সন্ধানে, অনেকে ফিরেছেন সফলতা অথবা ব্যার্থতা নিয়ে, অনেকে ফেরেনি কখোনই। কাজের মাঝে তিনি পরিচিত হয়েছেন দাকোপের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে, সবার জন্য তাঁর একটাই বার্তা– “যদ্দিন শরীর পারবে, মানুষের সেবা দিয়ে যাব।”  তাই এলাকাবাসীও সৃষ্টিকর্তার কাছে তার শারীরিক সুস্থতা কামনা করে। তিনি যেন সুস্থ থেকে এলাকাবাসীর সেবা দিয়ে যেতে পারেন।
Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

ঝিকরগাছার শংকরপুরে তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প আওতায় মাঠ দিবসের কারিগরি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত।

খুলনার দাকোপে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাজুয়াবাসীর ভরসার একটি নাম  ডা. মুরারি মোহন মণ্ডল  

Update Time : ১২:৫৫:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ অগাস্ট ২০২৩
মোঃ শামীম হোসেন- খুলনা প্রতিনিধিঃ-
খুলনার দাকোপে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাজুয়াবাসীর ভরসার একটি নাম  ডা. মুরারি মোহন মণ্ডল। কেননা দাকোপ উপজেলা ৯ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। যার ৫ টি ইউনিয়ন নিয়ে বাজুয়া বাজার। আর এখানে নেই কোন হাসপাতাল বা ডাঃ মুরারি মোহন মন্ডল ছাড়া অন্য কোন এমবিবিএস ডাক্তার। এলাকা বাসীর কাছ থেকে জানা যায় এই ৫ টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষের কেউ অসুস্থ হলে ডাঃ মুরারি মোহন মন্ডল হচ্ছে একমাত্র ভরসা যদি ডাক্তার রোগী দেখেন তাহলে সে বাজুয়াতে চিকিৎসা পাবে আর যদি না দেখে তবে তাকে হয় উপজেলা সদর বা খুলনার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নাই ভুক্তভোগী রোগীদের মধ্য থেকে জানায় ভাগ্য ভালো থাকলে সে রোগী বাঁচবে না হয় পথে মারা যাবে কারণ বাজুয়া থেকে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনেক সময় লাগে তাই ইমার্জেন্সি রোগী পথেই মারা যায়। বাজুয়ায় ডাঃ মুরারি মোহন মন্ডল ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। তাই তো কবির ভাষায় মন বলে, সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান, সেই তো তোমার দান। মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ সেই তো তোমার প্রাণ।” কিছু মানুষের অদৃশ্য অবদান আমাদের সমাজকে প্রতিনিয়ত ঋণী করে চলেছে। কিছু মানুষের কথা মনের ক্যানভাসে অজান্তে ফুটে ওঠে গভীর ভালবাসায়। মানবসেবার নামে যখন স্বার্থনেশীদের আত্মপ্রচারে দাকোপের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, ঠিক তখন নিভৃত পল্লীতে প্রচারবিমুখ একজন মানুষ মানবসেবার ব্রত নিয়ে, আত্মউৎসর্গ করে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। হ্যাঁ, আজকের গল্প এমনি একজন মহৎ মানুষকে নিয়ে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাজুয়াবাসীর ভরসার একটি নাম “মুরারি বাবু (ডা. এম. এম. মণ্ডল)”। এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায় অবিভক্ত বাংলায় সুন্দরবনের কোলঘেসে সদ্য জঙ্গল কেটে আবাদি জমিতে বসতি স্থাপন করেছে কৃষিনির্ভর এক জনপদ। জনশ্রুতিতে জানা যায় যে, এখানকার ঝোপ-জঙ্গল দা দিয়ে কুপিয়ে নির্মূল করা হয়। তাই এখানকার নামকরণ করা হয় দাকুপী। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে দাকুপী নামের কিঞ্ঝিৎ সংশোধন হয়ে দাকোপ নামে থানার প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৫ সালের প্রথম দিকের কথা, দাকোপের ছোট একটি গ্রাম খুটাখালী(বর্তমানে লাউডোব ইউনিয়নের অধীন)। খুটাখালী গ্রামে পিতা সতীশ চন্দ্র মণ্ডল ও মাতা কালীদাসী মণ্ডলের কৃষিনির্ভর অভাব-অনাটনের সংসার। সংসারে চার ভাই ও পাঁচ বোনের মাঝে ষষ্ট মুরারি মোহন মণ্ডল। দু’বিঘা জমি আর একটা ভিটা বাড়ীতে ঘরের চারপাশে কিছু ফলবান গাছ আছে। কষ্টে সৃষ্টে সংসার চালিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ার খরচটা জোগাড় করতেই পিতা সতীশ বাবুকে হিমশিম খেতে হয়। পাঠশালার পড়া শেষ  করে মুরারি মোহন ভর্তি হলেন বাজুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (স্থাপিত-১৯২০ সাল)।  অভাবের সংসারের টানাপোড়েনের মাঝ থেকে সফলতার সাথে ১৯৭৫ সালে প্রাথমিক শেষ করেন তিনি। অনেক অনিশ্চয়তার মাঝে মাধ্যমিক শুরু করেন উত্তর বানীশান্তা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টি তখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু ছিল(জুনিয়র স্কুল)। ১৯৭৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি প্রাপ্তিসহ উল্লেখযোগ্য নম্বর নিয়ে তিনি উত্তীর্ণ হন। পরে চলে আসেন এলাকার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম স্বনামধণ্য বিদ্যাপীঠ বাজুয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে(স্থাপিত-১৯২০ সাল)। ১৯৮০ সালে মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন দক্ষিণ বাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ বাজুয়া সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ে(স্থাপিত-১৯৭২ সাল)। ১৯৮২ সালে প্রথম শ্রেণী নিয়ে সফলতার সাথে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। অভাব অনটনে দিশেহারা বাবার কাছে উচ্চশিক্ষার খরচের আশা না করেই নেমে পড়েন উচ্চ শিক্ষার ভর্তি যুদ্ধে। সফলতা এলো! সফলতা এলো বাবা মায়ের, সফলতা এলো মুরারি মোহন মণ্ডলের, সফলতা এলো দাকোপের। দাকোপের চিকিৎসা অঙ্গনের জন্য এই সফলতা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। একান্ত আলাপচারিতায় তাঁর ভাষ্য-“আমি মেধাবী না, তবে পরিশ্রম করেছি, সফলতা পেয়েছি”। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে তিনি এমবিবিএস শেষ করে ১৯৮৯ সালে ফিরে আসেন এলাকার মানুষের সেবায়। শুরু হয় তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের। গল্পকথা বা ছোট বেলায় লেখা “Aim in Life” রচনা নয়। এটা বাস্তবতা, নিজের এলাকা বাজুয়া বাজারে ছোট্ট একটা রুমে তিনি শুরু করলেন চিকিৎসা সেবা। মাত্র ২০ টাকা, পরবর্তীতে এলে মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে তিনি সেবা দিলেন ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ সাল -৩০/২০ টাকা; ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল- ৪০/৩০ টাকা; ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল- ১০০/৫০ টাকা এবং ২০১৫ সাল থেকে ১৫০/১০০ টাকার বিনিময়ে তিনি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এরই মাঝে তিনি হয়ে উঠেছেন দারিদ্র জর্জরিত দাকোপবাসীর ভরসার একটি নাম, “মুরারি বাবু”; কুড়িয়েছেন অনেকের আশীর্বাদ ও ভালবাসা। একমাত্র মেয়ে মৈত্রী মণ্ডল(১৭), ছেলে স্বপ্নিল মণ্ডল (১৫) এবং সহধর্মিণী সঞ্চিতা রায়কে ঘিরে পারিবারিক জীবন। অনেকের কাছে রসকষহীন, এই মানুষটাকে খুব কাছে থেকে যারা না দেখেছে তারা বিশ্বাসই করতে পারবেন না যে তিনি কতটা রসিক। কথায় কথায় উঠে এলো তাঁর জীবনের নানান মজার ঘটনা, নানান আক্ষেপ এবং অনেক মূল্যবান কিছু মতামত। বড় আক্ষেপের জায়গা এলাকার সচেতন শিক্ষিত সমাজের উপর। অনেক উদাহরণ টেনে বললেন, যাদের কাছে সচেতনতা আশাকরি তারাই বেশি ভুল করে, অনিয়ম করে চিকিৎসায়। অথচ গরীব, অশিক্ষিত মানুষকে কিছু বললে তারা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তাঁর মতে, মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। সমাজে এসেছে অনেক পরিবর্তন। কিন্তু দাকোপ নামের এই বদ্বীপে এখনো তৈরি হয়নি কোন ভাল মানের চিকিৎসাকেন্দ্র, নেই উপজেলা সদরের সাথে সরাসরি কোন যোগাযোগ। নদীবেষ্টিত এপারের মানুষের জরুরী সেবার নেই কোন সুব্যবস্থা। এ বিষয়ে সরকারি পর্যায়ের সহযোগিতা কামনা করলেন তিনি।
২০১৬ সালের মে মাসে তিনি হৃদযন্ত্রের  বড় অপারেশন করতে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতে। অপারেশন শেষে এখন অনেকটা নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করছেন, আর দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা পরামর্শ, পুরানো সেই চেম্বরে। নিয়ম করে হাঁটছেন সকাল বিকাল। জানতে চেয়েছিলাম এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর মন্তব্য। তিনি বললেন, “আমাদের দেশে প্র্যাকটিক্যাল, লজিক্যাল , টেকনিক্যাল ও সাইনটিফিক বিকাশের উল্লেখযোগ্য কোন সুযোগ নাই। শুধু আছে মুখস্ত বিদ্যা বিকাশের সুযোগ । আর দাকোপের কথা আরো ভিন্ন! এখানে সব শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরাই পড়ে হয় শহরে, না হয় মংলা পারের নেভি স্কুলে। তার মানে শিক্ষকদের নিজেদের  আত্মবিশ্বাস কম। যদি এই বিশ্বাস থাকত যে নিজের স্কুলে ভাল পড়ালেখা হয় তাহলে সে নিজের সন্তানকে নিজের স্কুলেই দিত। ব্যাপারটা সামগ্রিক, আংশিক নয়। দুইএক জন যে ভাল নেই তা নয়, সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে দাকোপ পারের অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার এবং পাঠদানের মান উন্নয়ন তেমন হয়নি। তাই হয়তোবা অনেকে নদী পার হলে আর ফিরতে চান না এপারে। শত প্রতিকূলতার মাঝে কিভাবে সময় কাটে নিজের আপনজনের তা ভেবে দেখার সময়ই হয় না হয়তো অনেকের। নিজের চেম্বরে বসে দেখা যায় পারাপারের মানুষ; দেখেছেন অনেককেই পার হয়ে যেতে নদী, পাড়ি জমাতে শহরে ভাগ্যের সন্ধানে, অনেকে ফিরেছেন সফলতা অথবা ব্যার্থতা নিয়ে, অনেকে ফেরেনি কখোনই। কাজের মাঝে তিনি পরিচিত হয়েছেন দাকোপের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে, সবার জন্য তাঁর একটাই বার্তা– “যদ্দিন শরীর পারবে, মানুষের সেবা দিয়ে যাব।”  তাই এলাকাবাসীও সৃষ্টিকর্তার কাছে তার শারীরিক সুস্থতা কামনা করে। তিনি যেন সুস্থ থেকে এলাকাবাসীর সেবা দিয়ে যেতে পারেন।